তুমি নতুন বাংলাদেশ দেখতে পেতে। নিবিড় তিমির অমানিশা ভেদ করে নতুন সূর্য ছিনিয়ে এনেছে বাংলার ছাত্র-জনতা। আমরা দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলাম! এখন আর রাতের ভোট নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নাই।
যে নির্বাচন নিয়ে হুদা এবং তার দলের সঙ্গে পাঁচটা বছর তুমি একা লড়াই করেছ, সেই নির্বাচন কলুষমুক্ত হবে আশা করি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান সমস্ত হিসাব বদলে দিয়েছে। তোমার ভাষায় ‘মূক’ জনতার মুখে ভাষা ফুটেছে। জনগণ সবই দেখে, সবই বোঝে, শুধু একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠির জ্বলে ওঠার অপেক্ষা। তারা অধিকার আদায় করতে রাস্তায় নেমেছে। প্রবল শক্তিধর সিইসি নুরুল হুদাকে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। নুরুল হুদা পাঁচটা বছর তোমাকে কী পরিমাণ অপমান করেছে! তুমি ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলে, সেটা নিয়েও কতো কটূক্তি করেছে। কিন্তু তোমার শক্তি ছিল দেশের মানুষের ভালোবাসা। তারা তোমাকে গ্রহণ করেছিল।
তুমি তোমার কাজে অটল ছিলে। তুমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলে, তাই একাই লড়াই চালিয়ে গিয়েছ। পাঁচটা বছর নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভেতর থেকে যেভাবে দেখেছ, তাকেই কাগজে কলমে রূপ দিয়েছ। লিখেছ ‘নির্বাচননামা’। এটি একটি দলিল। এতে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রাসঙ্গিক নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখেছ। তুমি আশা করেছ, একদিন এই অমানিশা কেটে যাবে, নতুন সূর্য উঠবে। কবিরা স্বপ্নদ্রষ্টা, তারা ভবিষ্যৎ দেখতে পায়!
বিয়ের পর তুমি একদিন বলেছিলে, ছোটবেলায় তুমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলে, তোমার মরদেহের উপর ফুল দিয়ে ঢাকা। কী আশ্চর্য! তোমার কফিন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা দিয়ে ঢাকা হলো আর সেই পতাকার উপর ছিল পুষ্পস্তবক! তোমাকে গার্ড অব অনার দেয়া হলো। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, তোমার নির্বাচন কমিশনে কার্যকালের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। ‘নির্বাচননামা’ বইটি লিখতেও তোমার লাগলো পাঁচ বছর, আর ক্যান্সারে আক্রান্ত তোমার জীবন প্রদীপও নিভে গেল পাঁচ বছরেই!
তোমার কবি মন কেমন করে বুঝতে পেরেছিল যে, সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে! তাই তো তুমি লিখেছ, ‘মৃত্যুর পরেও আমার দু’চোখ উন্মীলিত থাকবে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য। মানুষ নির্বাচনের সাঁকো বেয়ে গণতন্ত্রের আবাসভূমিতে যথাযথভাবে পৌঁছাতে পারছে কিনা, সেটা দেখার জন্য। কেউ তখন আমার চোখের পাতা বন্ধ করে দেবেন না, এই প্রত্যাশা পরিবার-পরিজনের কাছে।’
* নীলুফার বেগম
- সহধর্মিণী এবং মুক্তিযোদ্ধা
একে একে তিনটি বছর পার হয়ে গেল, তুমি চলে গেছ। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! মনে হয়, এই তো তুমি লিভিং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছো, আমি কাছে গিয়ে তোমাকে ছুঁতে পারবো। আমাকে দেখে তুমি জিজ্ঞেস করলে, ‘আজ কি রান্না করছো?’ খাওয়া-দাওয়া তুমি খুব পছন্দ করতে।